কোমলমতি শিশুদের পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে অস্ট্রেলিয়ার মাইনক্রাফট নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে বিশেষ একটি ভিডিও গেম। যেটি খেলতে খেলতে শিশুরা জানতে পারবে পৃথিবী জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বন উজাড়ের মতো মানবসৃষ্ট কারণে হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর বিষয়ে। এ ছাড়া গেমটির মাধ্যমে শিশুরা আসন্ন ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি মোকাবিলার শিক্ষাও পাবে।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে পাঠ্যক্রমকে কীভাবে আরও ইন্টারেক্টিভ করে শিশুদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করা যায়, এ ধরনের ভাবনা থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে নতুন ধারার শিক্ষা উপকরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় উন্মোচিত হয় মাইনক্রাফট এডুকেশনের মোড়ক।
এরপর নিউ সাউথ ওয়েলসের শিক্ষা বিভাগ সেখানকার সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে মাইনক্রাফটের শিক্ষা সংস্করণটি বিনামূল্যের পরিষেবা হিসেবে প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যা পরবর্তীতে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে আশার আলো দেখাচ্ছে।
গবেষণা অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে মাইনক্রাফটের খেলার মাধ্যমে শিক্ষণ প্রক্রিয়ার প্রতি শিশুরা বেশি ঝুকঁছে। জোর করে পড়াশোনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে শিশুরা আনন্দ নিয়ে পড়ছে, নতুন কিছু শিখছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। গতানুগতিক চেয়ার-টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকার বিপরীতে ওপেন-প্লে প্লাটফর্মে উত্তেজনা ও উদ্ভাবনের দিকে প্রভাবিত হচ্ছে। শিক্ষকরাও পাঠ্যক্রম এবং সৃজনীশক্তিকে একত্র করতে সক্ষম হচ্ছেন। যা অন্যান্য সাধারণ গেইমের বৈশিষ্ট্য থেকে মাইনক্রাফটকে স্বতন্ত্র করেছে।
নিউ সাউথ ওয়েলসে বসবাসরত ভূগোল শিক্ষক ওয়ারউইক গুডসেল বেশ কয়েক বছর ধরে মাইনক্রাফটকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি উপলদ্ধি করেন, তার ছাত্ররা সার্ভারে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে খরা, দূষণ, নগরায়ণের মতো সমস্যার সমাধান করে এবং প্রকল্প নির্মাণ করে। কিন্তু এটি কেবল শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার রুমে পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর জন্য প্রয়োজন পড়ে প্রস্তুতির। কথায় আছে, প্রস্তুতি অর্ধেক যুদ্ধের সমান।
এ প্রসঙ্গে তিনি সিনেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘প্রথমে ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর ২০ মিনিট আলোচনা করতে হয়। তারপর বোর্ডে তাদের করণীয় সম্পর্কে মাইন্ড ম্যাপিং করে। এরপর তারা তাদের চিন্তাধারা মাইনক্রাফটে একীভূত করার চেষ্টা করে।’
উদাহর হিসেবে, বসবাসযোগ্যতা এবং সুস্থতার দিকে নজর দিয়ে যদি একটি শহর ডিজাইন করতে বলি, তাহলে প্রথমে প্রশ্ন হবে তারা কীভাবে সেখানে বসবাস করবে? যানবাহন কেমন হওয়া উচিত? এক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে সমস্যা সমাধানের আগে নাগরিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রস্তুতি পর্যন্ত, এই পাঠগুলো শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য মাইনক্রাফট ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায় সহায়তা করে।
গুডসেল বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বায়ু দূষণ এবং কোভিড মহামারি পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বায়ু প্রবাহের পথ সহজ করা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। তারপর তাদের একটি শহরের রাস্তার নকশা তৈরি করতে বলা হয়েছে, যা বায়ু প্রবাহের পথকে বাধাগ্রস্ত করবে না।’ এ প্রশ্নে একদল প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা বলেছে, ‘আমরা যদি উঁচু স্থাপনা তৈরি না করে নিচু স্থাপনা তৈরিতে নজর দিই, তাহলে বায়ুর প্রবাহপথ উন্মুক্ত থাকবে।’
গুডসেল সেক্ষেত্রে তাদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং ভৌগলিক অনুমান নির্ধারণ করে। একটি একক রাস্তায় বায়ুপ্রবাহ থেকে কীভাবে পুরো শহর পরিচালনা করা, বাঁধ নির্মাণ করা এবং তাদের শহরগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করে। জলবায়ু বিজ্ঞান শেখানোর জন্য বিশেষ মোড ও প্রকল্প ডিজাইনের মাধ্যমে ও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা দেয়।
নিউ সাউথ ওয়েলস এডুকেশন স্ট্যান্ডার্ড অথরিটির বক্তব্য অনুযায়ী, মূল পাঠ্যক্রমের ফলাফল মস্তিষ্কের শীর্ষে অবস্থান করে। মাইনক্রাফটের মাধ্যমে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুগুলো হাতে-কলমে অনুশীলন করে যে সুবিধা পাওয়া যায় তা অন্য কোথাও পাওয়া দুষ্কর। অর্থাৎ মাইনক্রাফট শুধু শেখাচ্ছে না, সচেতনতার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যোগ্যতা ও দক্ষতার হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
সম্প্রতিকালে ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ান বিমা কোম্পানি ন্যাশনাল রোড অ্যান্ড মোটরিস্ট’স এজেন্সি (এনআরএমএ), পিআর এজেন্সি ‘থিঙ্কারবেল’র সহযোগিতায় মাইনক্রাফট শিক্ষা সংস্করণ এবং মার্কেটপ্লেসে ক্লাইমেট ওয়ারিয়র্স নামে বিনামূল্যে একটি নতুন ইন্টারেক্টিভ গেম চালু করেছে। যেটি বিশেষত ৭ বছর বয়সী শিশুদের দাবানল থেকে কীভাবে নিজেদের এবং তাদের বাড়িগুলোকে রক্ষা করতে হবে তা শেখানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
২০২০ সালের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে দাবানলের আঘাতের ঘটনাকে আশ্রয় করে এই গেইমটির প্লট সাজানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করা হয়েছে যেন এটি তাদের বাড়ির আশেপাশেই আঘাত হানতে পারে। তবে এটি তৈরিতে নজর দেওয়া হয়েছে তাদের মনে যেন বিরূপ প্রভাব না পড়ে এবং তারা যেন নিজেদের নিরাপদ মনে করে।
গেমটির একটি অস্ট্রেলিয়ান ছোট উপকূলীয় গ্রাম নির্মাণে মাইনক্রাফট প্রতিষ্ঠান ব্লকওয়ার্কসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। গল্পটিতে জলবায়ু কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে- এবং কীভাবে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো আরও সাধারণ হয়ে উঠছে তা দেখানোর জন্য যেখানে এনআরএমএ-এর বাস্তব বিশ্বের ডেটা এবং জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণা ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্লকওয়ার্কসের প্রতিষ্ঠাতা জেমস ডিনালে বলেন, ‘এটি সত্যিই একটি সংবেদনশীল ঘটনা যা অনেক মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তাই আমরা এমনভাবে কাজ করেছি যাতে আমরা তথ্য-উপাত্তে সঠিক থাকি। কারণ এতে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িয়ে আছে।’
মাইক্রোসফটের উদ্ভাবনী শিক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং মাইনক্রাফটের বৈশ্বিক পরামর্শক স্টিফেন এলফোর্ড এর ভাষ্যমতে, ক্লাইমেট ওয়ারিয়র্স গেইমটি এনআরএমএ-এর সহযোগীতায় এমন একটি সহজ পাঠ্যক্রমের পরিকল্পনা করা হয়েছে যার ফলে শিক্ষকরা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করাতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘এই গেমে শিক্ষার্থীরা কী সম্পর্কে জানবে, তাদের করণীয় কী কী সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষকরা কখন ভিডিও থামিয়ে আলোচনা করবেন সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মাইনক্রাফট সহযোগী মনোভাব, দ্বন্দ্ব নিরসন, উচ্চস্তরের চিন্তাভাবনা, আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো সফট স্কিলগুলোর প্রতিও বিশেষ নজর দেয়। এলফোর্ড আরও বলেন, মাইনক্রাফট হলো এমন একটি জায়গা যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা ভুল করবে এবং শিখবে। এখানে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অনলাইন জগৎ এবং বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে ব্যবধান নিয়ে শিক্ষকদের আলোচনা করার একটি বিস্তর সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম ব্যবস্থার পরিবর্তনের পর আসে শিক্ষকদের পাঠদান প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা আনার যৌক্তিকতা। হাল আমলের অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে প্রযুক্তির কল্যাণকে সাদরে গ্রহণ করার মন-মানসিকতা এখনো আসেনি বলা চলে। যেখানে উন্নতর রিসোর্স উন্মুক্ত, তখনো কিছু শিক্ষক এবং অভিভাবক শ্রেণিকক্ষে গেইম খেলার বিষয়টি নেতিবাচক বলে মনে করছেন।
এটি হতে পারে প্রবীণ শিক্ষকদের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি ভয় কিংবা অনীহা এবং অভিভাবকদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অধিক উদ্বিগ্নতার ফলাফল। এ বিষয়ে এলফোর্ড বলেন, বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েরা চিন্তা এবং বুদ্ধিতে অতি তীক্ষ্ণ। শিক্ষকের প্রযুক্তিজ্ঞান থাকলেও শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। আর অভিভাবকের চিন্তার কারন নেই। কারন এই প্লাটফর্মটি তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে।
আর শিক্ষার ফলাফল বিষয়ে ২০১৭ সালে ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন-বছর মেয়াদে ভিডিও গেইম ব্যবহারকারী এবং অব্যবহারকারীদের উপর একটি গবেষণা করে। গবেষণাপত্রে ইন্টারেক্টিভ গেইম অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাখা অনুযায়ী, ‘তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ ব্যবহারকারী ভিডিও গেইম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরও সহজে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে এবং ৭৬ শতাংশ ব্যবহারকারীর মতে, ভিডিও গেইমের মাধ্যমে স্কুলগুলো পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারছে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী হালনাগাদ হতে পারছে।’
এছাড়া আইজিএর জরিপ অনুযায়ী, ভিডিও গেইম ব্যবহারকারী ৫ জন যুবকের মধ্যে ৪ জনই একমত প্রকাশ করেছেন যে, ভিডিও গেইমের মাধ্যমে শিক্ষণ প্রক্রিয়া কঠিন বিষয়বস্তু সহজে অনুধাবন করতে সাহায্য করছে। পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপের ফলে যে মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি তা থেকেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রম যত উন্নত হবে, আগামী প্রজন্ম তার সুফল ভোগ করতে সক্ষম হবে।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.