এক সময় তারা শত শত কোটি ডলার আয় করত। খ্যাতিও ছিল বিশ্বজোড়া। কিন্তু ব্যবসায়িক অসততা ও অব্যবস্থাপনা এসব জনপ্রিয় ব্র্যান্ড, তথা শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিকে পতনের পথে ঠেলে দেয়। তারা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, কিংবা একের পর এক ভুল করে গেছে। যে কারণে শেষ পর্যন্ত আর বাজারে টিকে থাকতে পারেনি কোম্পানিগুলো।
কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া এ রকম ১০টি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড বা কোম্পানির কথা আমরা এখানে তুলে ধরছি। ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যামেরা ও ফিল্ম ব্র্যান্ড কোডাক; পারসোনাল কম্পিউটার বা ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পিসি) প্রস্তুতকারক কমপ্যাক; বিনিয়োগ কোম্পানি লেহম্যান ব্রাদার্স; বিমান পরিবহন সংস্থা প্যান আমেরিকান এয়ারলাইনস (প্যান অ্যাম) ও ট্রান্সকনটিনেন্টাল অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন এয়ার (টিডব্লিউএ); ভিডিও ভাড়া দেওয়ার প্রতিষ্ঠান ব্লকবাস্টার; চেইন বুকশপ বর্ডারস; খেলনা বিক্রেতা টয়জ আর ইউ; জ্বালানি কোম্পানি এনরন এবং খুচরা বিক্রেতা উলওয়ার্থ।
কোডাক: ক্যামেরা ও ফিল্ম কোম্পানি
ক্যামেরা ও ফিল্ম তৈরির কোম্পানি বলতে মানুষ একসময় কোডাক ব্র্যান্ডের কথাই ভাবত। কারণ, ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বে ক্যামেরা ও ফিল্মের ব্যবসায়ে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে এই কোম্পানিই ছবি তোলার সুবিধা পৌঁছে দিয়েছিল। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কোডাক কোম্পানি ১৯৭০-এর দশকে ডিজিটাল ক্যামেরার উন্নয়নেও বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। তারপরও ডিজিটাল ক্যামেরার আরও উৎকর্ষ সাধন ও বিক্রি বৃদ্ধিতে তেমন পদক্ষেপ না নেওয়ায় পিছিয়ে পড়ে কোম্পানিটি।
এরই মধ্যে বৈশ্বিক বাজারে স্মার্টফোনের আবির্ভাব ঘটে। দিন দিন স্মার্টফোনে অনেক শক্তিশালী ফোন সংযোজিত হতে থাকে। অন্যদিকে ছবি প্রিন্ট করার প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। কারণ, তত দিনে মানুষ অ্যালবামের পরিবর্তে কম্পিউটার, গুগলসহ নানাভাবে ছবি সংরক্ষণের সুযোগ পেয়ে গেছে। ফলে মন্দার মুখে পড়ে কোডাক। তাই ২০১২ সালে কোডাক নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। ১২৩ বছরের পুরোনো ব্যবসা ছেড়ে কোম্পানিটি মার্কিন সরকারের কাছ থেকে ৭৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের কারখানা গড়ে তোলে। এখন এটিই তাদের ব্যবসা।
কমপ্যাক: পিসি ব্র্যান্ড
১৯৮২ সালে একটি পারসোনাল কম্পিউটার বা ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পিসি) প্রস্তুতকারক হিসেবে যখন আবির্ভূত হয় কমপ্যাক, তখন আইবিএম এ ক্ষেত্রে যেন বিশালকায় এক দৈত্য। বাজারে এ রকম প্রবল শক্তিধর কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও, প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মধ্যেই পোর্টেবল পিসি ও পিসি গাইডের মতো পণ্য চালু করে ফরচুন ৫০০ কোম্পানির তালিকায় স্থান পায় কমপ্যাক। কিন্তু বেশ কিছু ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে ৯৬০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট করপোরেশনকে অধিগ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালে কমপ্যাকের বিক্রি কমে যায়। তত দিনে পিসির বাজার চলে যায় ডেলের নিয়ন্ত্রণে। ২০০২ সালে এইচপি আড়াই হাজার কোটি ডলারে কমপ্যাককে অধিগ্রহণ করে সেই ব্র্যান্ডের নামেই পণ্য তৈরি করতে থাকে। তবে ২০১৩ সালে এইচপি আনুষ্ঠানিকভাবে কমপ্যাক ব্র্যান্ড বন্ধ করে দেয়।
লেহম্যান ব্রাদার্স
যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৭-০৮ সালের সাবপ্রাইম ক্রাইসিস, তথা বন্ধকি ঋণের সংকট বিশ্ব অর্থনীতিকেই মন্দার মুখে ঠেলে দেয়। এতে সবচেয়ে বড় দুর্দশার শিকার হয় ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান লেহম্যান ব্রাদার্স। ১৯৯৪ সাল থেকে লোকসান দিয়ে আসা লেহম্যান ব্রাদার্স বন্ধকি ঋণের চাপ সইতে পারেনি। ফলে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে আদালতের দ্বারস্থ হয়। তখন বিশ্বব্যাপী এই কোম্পানির জনবলসংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। আর ৬৪ হাজার কোটি ডলারের সম্পদের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ছিল ৬১ হাজার কোটি ডলার।
প্যান অ্যাম: বিমান সংস্থা
যুক্তরাষ্ট্রের প্যান আমেরিকান এয়ারলাইনস (প্যান অ্যাম) একটি মর্যাদাশীল বিমান সংস্থা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাজারের চাহিদার তুলনায় বিমানবহর বড় করা এবং জ্বালানির দাম বাড়ায় আশির দশকে ব্যাপক চাপে পড়ে যায় প্যান অ্যাম। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত প্যান অ্যাম অব্যাহত লোকসানের মধ্যে নিউইয়র্কের নিজস্ব প্যান অ্যাম ভবনসহ বিভিন্ন সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এর ওপর ১৯৮৮ সালে প্যান অ্যামের একটি বিমান স্কটল্যান্ডের লকারবিতে বোমা হামলার শিকার হয়। লোকসান-বিপর্যয়ের ধকল কাটাতে না পেরে ১৯৯১ সালে দেউলিয়া ঘোষিত হয় কোম্পানিটি।
ব্লকবাস্টার: ভিডিও চেইন
বিশ্বের এখানে-ওখানে-সেখানে স্টোর বা শাখা খুলে ভিডিও ভাড়া দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের করপোরেট মালিকানাধীন কোম্পানি ব্লকবাস্টার। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্লকবাস্টার বিশেষ করে তরুণদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে বিশ্বজুড়ে ব্লকবাস্টারের স্টোর বা শাখার সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে যায়। শনিবার রাতে তরুণদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠত ব্লকবাস্টারের শোরুমে। কিন্তু এরই মধ্যে দেশে দেশে ব্যক্তিমালিকানায় পাড়ায়-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো সিডি-ডিভিডি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ব্লকবাস্টার নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে না পারায় পিছিয়ে পড়ে। এটি বড় মার খায় নেটফ্লিক্সের আবির্ভাবের পর। ২০১০ সালে ব্লকবাস্টার দেউলিয়া ঘোষিত হয়। আর ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সব শাখা বন্ধ হয়ে যায়।
বর্ডারস বুকশপ: বই বিক্রেতা
১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা চেইন বুকশপ বর্ডারস ক্রেতাদের জন্য ক্যাফে খুলেছিল। ইন্টারনেট ব্রাউজ করে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী বই, গান ও সিনেমা-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য জানার সুযোগও এনে দিয়েছিল। অথচ এ রকম একটি গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান টিকতে পারেনি। এটি ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ওঠে যায়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ তখন এটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খুচরা বই বিক্রেতা বা চেইন বুকশপ। বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়ার সুযোগ এবং সুপার মার্কেটগুলোয়ও বই বিক্রি করায় বর্ডারস বুক শপের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজন অনলাইনে বই বিক্রি শুরু করায় বর্ডারস বুকশপের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।
টয়জ আর আস্: খেলনা বিক্রেতা
অপ্রয়োজনীয় অনেকগুলো শাখা খোলার কারণে বিপাকে পড়ে খেলনা বিক্রেতা টয়জ আর আস্। ফলে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠানটির সব স্টোর বা বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া ঘোষিত হয়। এশিয়া অঞ্চলের স্টোরগুলো অবশ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে চালু রাখে। খুচরা পণ্য বিক্রিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কেট হার্ডক্যাসল বলেন, ‘টয়জ আর আস্–এর দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হওয়ার ঘটনা ছিল হৃদয় ভাঙার মতো। কারণ, ক্রেতারা তাঁদের সন্তানদের জন্য টয়জ আর আস্’র মতো সেরা ব্র্যান্ডের খেলনাই কিনতে চান।’
এনরন: বৈশ্বিক জ্বালানি কোম্পানি
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক জ্বালানি কোম্পানি এনরনের জালিয়াতি প্রকাশ পায়। ফলে ওই বছরই কোম্পানিটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের তদন্তে জালিয়াতি ধরা পড়লে তারা ১৯৯৭ সাল থেকে হিসাব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর কথা স্বীকার করে। ২০০৮ সালে শেয়ারহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীরা এনরন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে মামলা করেন। এনরন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে।
উলওয়ার্থ: বিশ্বের বৃহত্তম খুচরা বিক্রেতা
একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা ছিল উলওয়ার্থ। কিন্তু কর্মদক্ষতায় দুর্বলতা ও গতিশীলতার অভাবে কোম্পানিটি শেষ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে উলওয়ার্থের সব স্টোর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ, কোম্পানিটি যা আয় করছিল, তার চেয়ে তাদের খরচের পরিমাণ বেশি ছিল।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.