শিক্ষা

সরকারি স্কুলে অসন্তোষ, কিন্ডারগার্টেনে ঝুকছেন অভিভাবকেরা

আমাদের দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে নানা রকম সুযোগ সুবিধা সহ অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী এবং বিনা বেতনে শিশুদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ থাকলেও বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার প্রতি অভিবাবকের আস্থা ও ভরসা বেশি। যার ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে  দিনদিন ছাত্রছাত্রী সংখ্যা তুলনামূলক কমতে শুরু করেছে। 

তারই অংশ হিসাবে বেনাপোল পৌরসভা এবং ইউনিয়নের প্রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংকট বাড়ছে দিনকে দিন। অভিবাবকেরা তাদের সন্তানদের এখন কিন্ডারগার্টেনমুখী শিক্ষার দিকে বেশি অগ্রসর হচ্ছেন।

এর কারণ হিসাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান নিয়ে প্রশ্ন প্রশ্ন তুলেছেন অভিবাবকেরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে তদারকির দাবি সহ শিক্ষকদের আরো বেশি আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে, বেনাপোল পৌরসভায় ও ইউনিয়নে ১৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। সেই সঙ্গে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় ২৭টির অধিক। যার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক গুণ বেশ। 

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কাগজপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। অন্য শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার্থীদের আসন ফাঁকা ছিল। এ সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী না থাকার বিষয়ে সংশ্নিষ্টরা দাবি করেন স্কুলে খেলাধুলা চলায় এবং সকল বই বিতরণ করতে না পারায়  বিদ্যালয়ে উপস্থিতি একটু কম। যদিও দিনের হাজিরা খাতা অনুসন্ধানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি পাওয়া যায় আশানুরূপ। একই ধরনের অবস্থা দেখা গেছে নারায়নপুর নতুনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। খবর নিয়ে দেখা যায় এই বিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি সহ এখন পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী সংখ্যা মাত্র ৯৪ জন।

 এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিক দ্বিন মোহাম্মদ জানান, আমাদের বিদ্যালয়টি ছোট একটা গ্রামের মধ্যে অবস্থিত, এখানে এমনিতেই ছাত্রছাত্রী কম তার উপরে আছে কিন্ডারগার্টেনের চাপ। এখন আরো নতুন ভাবে চাপ তৈরি করছে ইসলামি কিন্ডারগার্টেন গুলো। এখানে দ্বীনি শিক্ষার সাথে ক্যাডেট চালু হওয়ায় অভিবাবকেরা এই শিক্ষার দিকে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এসকল ইসলামি কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের পরবর্তী ভবিষ্যৎ কি সেটা নিয়ে অভিবাবক সহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের ভাবনার বিষয় রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, অনেক ছাত্র বিদ্যালয়ে আসে না। তারা কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। শুধু শিক্ষা উপবৃত্তির জন্য ভর্তি হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে। কারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উপস্থিতি না থাকলেও নিয়মিত উপবৃত্তি তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। তবে এসকল বিষয় এখন আর কোথাও চালু নেই বলে অস্বীকার করেছেন সকলেই।

জানা গেছে, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ উপেক্ষা করে অভিভাবকরা শিক্ষা বাণিজ্যের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কারণ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষার্থী ধরতে চালানো হয় নানা প্রচার প্রচারণা। এ ক্ষেত্রে চাকচিক্যই তাদের মূল কথা। তবে ভিন্ন কথা বলছেন শিক্ষার্থী অভিভাবকরা। তাদের মতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় তদারকির অভাব রয়েছে। এর বিপরীতে কিন্ডারগার্টেনে তদারকি ও আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই। আছে জবাবদিহিতার সুযোগ সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে অজুহাতের পাহাড়।

সাইবুর রহমান নামের এক অভিভাবক জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন আছে, খেলার মাঠ আছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকও আছেন। কিন্তু পড়ালেখার মানের প্রশ্নে অভিভাবকদের সন্তুষ্টির অভাব আছে। তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত ও যথাসময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন না। ক্লাসে পাঠদানের বিষয়ে আন্তরিক নন শিক্ষক শিক্ষিকারা। এসব কারণে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আগ্রহ বাড়ছে।

কথা হয় সানরাইজ কিন্ডারগার্টেনের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থীর মা সোনিয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কিন্ডারগার্টেনে স্কুলগুলোতে যেভাবে যত্ন নিয়ে পড়ানো হয়, প্রাথমিকে বিদ্যালয়ে তা হয় না। এজন্য অভিভাবকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবর্তে কিন্ডারগার্টেনে তাদের সন্তানদের পড়ান।

তবে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ইজ্জত আলী’র দাবি করেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের ওপর ব্যাপক তদারকি রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসন এই ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করায় সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায় তিনি শিক্ষা ও বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন।

বেনাপোল বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয়টি সাজানো গোছানো এবং পরিপাটি। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শৌচাগার পর্যন্ত ঝকঝক করছে। বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলও ভালো।  তারপরও কেন বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী বাড়ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে সহকারী শিক্ষক আলাউদ্দিন বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে অভিবাবকদের বেশি আগ্রহ দেখানোর কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন সময়সূচি কে। তারমতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের ক্লাস টাইম ২ঘন্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪ঘন্টা, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে ৪ঘন্টা থেকে  ৬ঘন্টার অধিক। যেটা শিশুদের জন্য কষ্টদায়ক এবং বেশিরভাগ সচেতন অভিবাবক এটা পছন্দ করেন না। তথ্য নিয়ে জানা যায়, গত বছর কাগজপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ৩৩৭।

বর্তমানে এক বছরের ব্যবধানেও এই বিদ্যালয়টিতে নতুন শিক্ষার্থী বাড়েনি। অথচ বিদ্যালয় এলাকার ওইসব কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সংখ্যা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কাগজপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহানাজ পারভিন বলেন, আমরা বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কিন্ডারগার্টেনমুখী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে বেশিরভাগ অভিবাবকই মনে করেন তাদের সন্তান কিন্ডারগার্টেনে না পড়লে তারা সমাজে সম্মানের সহিত পরিচয় দিতে পারবেনা। 

এসকল বিষয়ে জানতে চাইলে শার্শা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আমরা প্রতিমাসেই পরিদর্শনে যাচ্ছি। তারপরও কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে অঘোষিত প্রতিযোগিতায় থাকতেই হচ্ছে। তিনি আরো বলেন বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক উন্নত হচ্ছে, বাচ্চাদের বইয়ের চাপ কম, যদিও সময় একটু বেশি নিয়ে পড়ানো হয় তবে সামনের দিনে স্কুলেই বাচাদের টিফিনের ব্যবস্থা করা হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো অভিবাবকদের খুশি করতে বাচ্চাদের রেজাল্ট দেখায় বেশিরভাগই ১০০ তে ১০০ এছাড়াও এসকল প্রতিষ্ঠানের নানা প্রলোভন চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন, সমাজে স্টাটাস মেইনটেইন সহ ইত্যাদি কারণে তারা অভিবাবকেরা এদিকে ঝুকছেন। তবে কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালনার বিষয়ে সরকারের একটা নীতিমালা থাকা অতিব জরুরি।

এসকল বিষয়ে বেনাপোলের কয়েকজন সচেতন নাগরিক বলেন, দিনদিন নানা কারণে বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার পণ্যে পরিণত হচ্ছেন অভিবাবকেরা। অভিবাবকদের যেমন এবিষয়ে সচেতন হতে হবে তেমনি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সহ কর্মকর্তাদেরও আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। সরকারি স্কুলের অনেক শিক্ষক ভুলে যাচ্ছেন যে তারা একটি মহান পেশায় নিয়োজিত আছেন। কিছু শিক্ষকদের শুধুমাত্র বেতন তোলা মনোভাব ঝেড়ে ফেলে অজুহাত বাদ দিয়ে সৃজনশীল মানসিকতার হয়ে প্রতিযোগিতা মুলক মনোভাব পোষণ করলে শিক্ষা ব্যবস্তার উন্নতি হবে মনে করেন তারা। এর সাথে জনগণের মৌলিক চাাহিদা ও অধিকারের মধ্যে শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেদিকেও সরকার ব্যাপক সংস্কার করবেন বলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি করেন তারা।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker