সালিশে অপমান সইতে না পেরে গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেছে নওগাঁর রানীনগরের ৭০ বছরের বৃদ্ধ ও গ্রাম প্রধান আলহাজ্ব মো: সখিমুউদ্দীন সকু। তিনি একই উপজেলার পাকুরিয়া গ্রামে মৃত হেকমত আলীর পুত্র। দীর্ঘদিন ধরে আবাদপুকুর বাজারের চারমাথা বসবাস করে আসছিলেন।
ঘটনাটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। বুধবার ভোররাতে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান। ময়না তদন্ত শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার এই মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
নিহতের বড় ছেলে সিরাজুল ইসলাম ও এলাকাবাসীদের সুত্রে জানা গেছে, ঈদের দিন বিকেলে কোরবানীর মাংস নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে বিভিন্ন আত্নীয়ের বাড়ীতে বিতরণ করার সময় আবাদপুকুর চারমাথা মোড়ে আসলে এক ভ্যানের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে মটরসাইকেল চালক সিরাজুল ডান হাতে ও পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরে ভ্যান চালকের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় সিরাজুল দু’একটা চর থাপ্পর মারেন। ভ্যানে থাকা যাত্রী পাকুরিয়া গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে আ. জলিল প্রতিবাদ করলে তার সঙ্গেও বাকবিতন্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। খবর পেয়ে সিরাজুলের অন্যান্য ভাইয়েরা আসলে তাদের সঙ্গেও বাকবিতন্ডা হলে এক পর্যায়ে লোকজন এসে উভয় পক্ষকে ওই স্থান থেকে বিদায় করে দিলে তারা বাড়ী চলে যান।
আ: জলিল পরদিন থানায় অভিযোগ দায়ের করলে থানার অফিসার ইনচার্জ আবু ওবায়েদ বিষয়টি একডালা পুলিশ ফাঁড়ীর ইনচার্জ এসআই ফরিদ উদ্দীনের নিকট বিষয়টি দেখার জন্য নির্দেশ দেন। এসআই ফরিদ উদ্দীন বিষয়টি নিয়ে মিমাংসার জন্য মঙ্গলবার উভয় পক্ষকে আবাদপুকুর কলেজ মাঠে সালিশ বৈঠক ডাকেন। তাতে সিরাজুলরা ৩ ভাই ও তার বাবা সখিমুদ্দীন এবং অপর পক্ষ ভ্যান চালক ও যাত্রী আ: জলিলসহ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাজাহান ও সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলামসহ পুলিশের এসআই ফরিদ ও আর একজন সদস্য উপস্থিত থাকবেন বলে জানান। এসআই ফরিদের কথামত তারা কাউকেও না নিয়ে চলে যায় সালিশে। গিয়ে দেখে প্রতিপক্ষের প্রায় শতাধিক লোক। বিষয়টি দেখে এসআই ফরিদকে জানালে তিনি বলে কোনো অসুবিধা নাই বলে আশ্বস্ত করেন। সালিশে বিস্তারিত কোনো কিছু না শুনে একতরফাভাবে তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ৪ সদস্যের একটি জুড়ী বোর্ড গঠন করে দেন এসআই ফরিদ ও চেয়ারম্যান শাজাহান আলী।
জুড়ি বোর্ডের সদস্যরা হলেন, এসআই ফরিদ ও আর একজন ফাড়ির পুলিশ সদস্য, চেয়ারম্যান শাজাহান আলী ও সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম। জুড়ী বোর্ডে তাদের কোনো লোক ছিল না। জুড়ি বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় এসআই ফরিদ।
সিরাজুলসহ তার ৩ ভাই ও তার বাবা সখুমদ্দিনকে ৮ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। জরিমানার টাকা ৫ হাজার আ: জলিলকে এবং ৩ হাজার টাকা ভ্যানচালককে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর হাত ধরে ক্ষমা চাইতে হবে পিতাসহ তাদেরকে এই সালিশে। বাধ্য হয়ে নগদ টাকা দিয়ে সিরাজুলেরা দুই ভাই ও তার বাবা কোনো অপরাধ না করেও প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ায় ওই মাঠ থেকে চলে আসে। তবে তার ছোট ভাই কোনো ক্ষমা চায় না।
সখুমুদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকার বিচার সালিশ করে আসছিলেন। তাকে ছাড়া ওই ইউনিয়নে কোনো বিচার সালিশ হয় নাই। জোর করে ক্ষমা চাওয়ায় সে সহ্য করতে না পারায় ওই মাঠ থেকে এসে বাজারে এক দোকান থেকে গ্যাসের ট্যাবলেট নিয়ে সবার অজান্তে খেয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ পর অবস্থা বেগতিক হলে তার ছেলেদের কাছে খবর দিলে তার ছেলেরা প্রথমে বাজারের একটি ক্লিনিকে এরপর রানীনগর হাসপাতালে এবং সেখান থেকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দেন।
সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ওই রাতে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার ভোররাতে সেখানে তার মৃত্যু হয়। লাশ ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের নিকট হস্তান্ত করলে লাশ নিয়ে বাদ আসর আবাদপুকুর কাচারী মাঠে প্রথম নামাজে জানাজা ও পরে পাকুরিয়া ঈদগাহ মাঠে ২য় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করেন।
এ ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান শাহজান আলী বলেন, আমি জুড়ি বোর্ডের সদস্য থাকলেও ওই সালিশ বৈঠক আমি ডাকি নাই। ডেকেছেন একডালা ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ফরিদ উদ্দিন। বৈঠকে আলহাজ মো: সখিমুউদ্দীনের ৮ হাজার টাকা জরিমানার মধ্যে ৩ হাজার টাকা ভ্যান চালক এবং ৫ হাজার টাকা আব্দুল জলিলকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে সকিন উদ্দিন এবং তার ছেলেদেরকে ওই শালীর বৈঠকে প্রতিপক্ষের কাছে ক্ষমা চান।
একডালা ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ফরিদ উদ্দিন জুড়ি বোর্ডে সদস্য থাকার কথা স্বীকার করলেও মিটিং ডাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
রানীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ আবু ওবায়েদ বলেন, তিনি এ বিষয়ে তিনি লোকমুখে এসব ঘটনা শুনেছেন তবে কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ দেননি।