সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে শুরুর আগেই বন্ধ করতে বাধ্য হলো বস্ত্র, হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রদর্শনী
টাঙ্গাইলের বল্লা এলাকায় “বস্ত্র, হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রদর্শনী” নামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজনের সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হলেও শুরুর আগেই তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন আয়োজকরা। স্থানীয় সমাজপতিদের দাবির পর আয়োজকরা তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত?
প্রদর্শনীটি ২৫ ডিসেম্বর থেকে বল্লা করোনেশন হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শুরু হওয়ার কথা ছিল। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল টাঙ্গাইল শাড়িসহ বল্লার ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প এবং হস্ত ও কুটির শিল্পের পণ্য সরাসরি ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরা। তবে শেষ মুহূর্তে স্থানীয় সমাজপতিরা প্রদর্শনী বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তাদের ভাষ্যমতে, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এ আয়োজন করতে দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রদর্শনীর আয়োজকরা জানান, তারা সমাজের নেতৃবৃন্দের অনুমতি নিয়ে আয়োজনটি শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সমাজের নির্দেশে তারা এটি বন্ধ করতে বাধ্য হন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, “আমরা সমাজকে সম্মান করে এবং তাদের মতামতকে মূল্য দিয়ে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে, প্রদর্শনী বন্ধ হওয়ায় আমাদের উদ্যোক্তারা হতাশ হয়েছেন। তারা চেয়েছিলেন নিজেদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত পণ্য প্রদর্শন করতে।”
আয়োজকদের একজন বলেন, “আমরা সমাজের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করে এই প্রদর্শনী বন্ধ করেছি। তবে এখনো জানি না, এই বৃহত্তর স্বার্থ আসলে কী বা কেন এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর।”
প্রদর্শনী বন্ধের বিষয়টি তাঁত শিল্পীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। একজন তাঁতী বলেন, “আমরা অনেক আশা নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এই প্রদর্শনীতে পণ্য বিক্রি করে কিছুটা আয় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সবকিছুই অনিশ্চিত।”
এদিকে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা সব নিয়ম মেনেই প্রদর্শনী আয়োজনের অনুমতি নিয়েছিলেন এবং সমাজপতিদের উপস্থিতিতে প্রদর্শনীর কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্তে তাঁরা হতবাক।
অনেকে ধারণা করছেন, কারও প্ররোচনায় এমনটি ঘটেছে। স্থানীয়রা বলছেন, এই প্রদর্শনী বল্লার ঐতিহ্যকে বাঁচানোর জন্য একটি বড় উদ্যোগ হতে পারত। তাঁতশিল্প ইতোমধ্যে ধ্বংসের মুখে। এই প্রদর্শনীতে তাঁতশিল্পীরা সরাসরি ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতেন, যা তাঁদের জন্য আর্থিকভাবে খুবই সহায়ক হতো।
প্রযুক্তি আর ঐতিহ্যের টানাপোড়েন
বল্লার তাঁতশিল্প মূলত হাতে বোনা শাড়ির জন্য বিখ্যাত। তবে বর্তমানে পাওয়ার লুম প্রযুক্তির কারণে হাতে বোনা শাড়ির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এখন প্রতিদিন একটি পাওয়ার লুমে ৪-৭টি শাড়ি তৈরি হয়। ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি লুমে মাত্র ১-২টি শাড়ি তৈরি হয়।
তরুণ উদ্যোক্তারা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। তবে, নারীদের শাড়ি ব্যবহারের অভ্যাস কমে যাওয়া এবং বাজারে মন্দার কারণে অনেক তাঁত ব্যবসায়ী বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন। কিছু ব্যবসায়ী তাঁদের তাঁত বিক্রি করে দিচ্ছেন, যা এই শিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আয়োজকদের একজন বলেন, “আমরা এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাঁতশিল্পকে নতুন করে তুলে ধরতে এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ।”
আজ শুক্রবার জুমু’আর নামাজের খুতবায় বল্লা আল মুকাররাম জামে মসজিদের ইমাম শাইখ ওবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল ওয়াহেদ প্রদর্শনী বন্ধের প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, “হতাশ হওয়া যাবে না, নিরাশ হওয়া যাবে না, আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখতে হবে। কিছুদিন যাবৎ ব্যবসায়ী ভায়েরা একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করে সামাজিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে এটা বন্ধ ঘোষণা করেছেন।”
তিনি আরো বলেন, “যদি শুধুমাত্র কাপড়ের স্টল দিয়ে এর ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখতে পারতেন, সেটা কিছু শর্ত সাপেক্ষে জায়েজ হতো। তবে মেলায় নারীদের ভিড়, ইভটিজিং এবং অশ্লীলতার মতো বিষয়গুলো প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। পুলিশ দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এই ধরণের আয়োজন বল্লা সমাজের সাথে যায় না।”
ইমাম শাইখ আব্দুল্লাহ ব্যবসায়ীদের প্রতি ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখতে অনেক সময় অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়। একজন মুসলিম হিসেবে যেখানে হারাম কিছু হওয়ার আশঙ্কা করে, সেখানে থাকা উচিত নয়।”
তিনি খুতবায় ব্যবসায়ীদের ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের প্রতি একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান এবং মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সমাধান খোঁজার পরামর্শ দেন।
সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার জন্য আয়োজকরা প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। তবে প্রদর্শনী বন্ধ হওয়ার ঘটনায় বল্লা অঞ্চলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প রক্ষায় এ ধরনের উদ্যোগ বন্ধ হওয়া এই শিল্পকে কতটা প্রভাবিত করবে, তা সময়ই বলে দেবে। ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প বাঁচাতে স্থানীয় সমাজপতিদের আরও সচেতন ও সহায়ক ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।