কিশোরগঞ্জ

লোকসংস্কৃতির নিঃশ্বাস যাত্রাপালা, এখন শুধুই স্মৃতি।

মাহফুজ রাজা,কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি:

“যাত্রাপালা”গ্রাম বাংলার আবহমানকাল থেকে চলে আসা অন্যতম একটি শৈল্পিক বিনোদনের মাধ্যম। তবে কালপরিক্রমায় এ শিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন।

Image

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরেও এককালে দেখা যেতো রমরমা যাত্রা পালার আয়োজন।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছিল যাত্রাপালার দল।সিদলা ইউনিয়নের সাহেবের চর গ্রামে মুক্তার উদ্দিনের তত্বাবধানে সাগর ভাসা নামেও একটি যাত্রাপালা ছিলো। যাতে পুরুষ অভিনেতা সকলই ছিলো একই গ্রামের। ধীরে ধীরে হোসেনপুরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাঙালির এককালের বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ যাত্রাপালা। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আবর্তে পড়ে বাঙালির লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য এই যাত্রাপালা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একই কারণে উঠে যাচ্ছে সার্কাস-পুতুল নাচ। গ্রামীণ মেলাগুলো তেমন আর জমছে না। এখন আর সন্ধ্যা নামলেই মেলা থেকে লাউড স্পিকারে আর ভেসে আসে না- ‘হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার…অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ।

Image

হালের বলদ জোড়া বিক্রি করে যাত্রাদল করা মানুষের অভাব নেই এ উপজেলায়, অভাব শুধু   পরিবেশ পরিস্থিতি। মানুষ এখন বিনোদন থেকে মুখ ফিরিয়ে হিংসা-প্রতিহিংসায় ও স্বার্থের লোভে মত্ত।

যাত্রাপালা দেখার জন্য দর্শকরা রাতভর বিনিদ্র থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আর অপেক্ষায় প্রহর গোণেন না। শীতে মেলা বসবে, যাত্রাপালা আসবে—সেই প্রতীক্ষায় থাকে না আর গ্রামের মানুষ। এখন যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ মানেই কদর্য নৃত্য-জুয়া-হাউজির ধুন্ধমার কারবার। ফলে যাত্রার কথা মনে হলে পুরান, ইতিহাস, মহর্ষী ব্যক্তিত্ব বা লোকজ সাহিত্যে বিখ্যাত চরিত্রের কথা আর মানস পটে ধরা দেয় না, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে স্বল্প পোশাকে কথিত প্রিন্সেসদের উদ্বাহু- নাচ-গানের অশালীন দৃশ্য।

একটা সময় উপজেলার গ্রাম-বাংলার মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল যাত্রাপালা। এসব যাত্রাপালায় লোককাহিনী, ঐতিহাসিক ঘটনাসহ সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা অভিনয়ের মাধ্যমে সরাসরি তুলে ধরা হতো। বিশেষ করে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মাঝে সিদলা ইউনিয়নে বেশিই ছিলো যাত্রাপালা প্রেমী।  শীতকালে গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা আয়োজনের হিড়িক পড়ত। মানুষ শীতের মধ্যেই রাতভর যাত্রাপালা উপভোগ করত। যাত্রার সেই দিন এখন নেই। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা ঐহিত্যবাহী এ শিল্প বাঁচানোর তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই পারে এ ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন,আমাদের সবার স্ব স্ব জায়গা থেকে ঐতিহ্যবাহি এই শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

খ্যাতিমান যাত্রাভিনেতা তোতা নেওয়াজ খান বলেন, যাত্রা বিনোদনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগ্রাম আন্দোলনকে বেগবান করেছে। যাত্রা লোক শিল্পের বাহন। যাত্রা যুগে যুগে মানুষকে সাম্যের বাণী শুনিয়েছে। বিভিন্ন সংগ্রামে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। 

একসময়কার যাত্রানায়ক মাহফুজ রাজা বলেন,এই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পালাকার, গায়ক, অভিনয়শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, দলনেতা, মালিক, পরিচালক, যন্ত্র শিল্পীসহ অসংখ্য মানুষের জীবিকা।তিনি বলেন, যাত্রা শিল্পের পেশাগত কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখনো যাত্রানুষ্ঠান হয়, কখনো বন্ধ হয়ে যায়। এর কোনো নীতিমালা নেই। সংশ্লিষ্টরা যদি এর একটি নীতিমালা করত, তাহলে যাত্রাশিল্পের পেশাগত সংকটের অবসান ঘটত এবং বাংলার আদিকালের এই শিল্প রক্ষা পেত। 

যাত্রাশিল্পী সাহাবুদ্দিনের  সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল যাত্রাশিল্পীদের জন্য সুদিন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এ শিল্পে অশ্লীলতা, জুয়া ঢুকে পড়ে।আর মানুষের অনিহার যায়গা হয় এটি।

তবে কিছুটা আলোর সন্ধান মিলতে দেখা যাচ্ছে এ যাত্রাপালা শিল্পের। 

জানা গেছে,অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় শিল্প নিয়ে পৌঁছে যাবো আমরা উন্নতির শিখরে- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে শুরু হলো দেশজুড়ে ১৯ দিনব্যাপী যাত্রাপালা উৎসব। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সর্বসাধারণকে সম্পৃক্ত ও অনুপ্রাণিত করতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ১২০টি যাত্রাদলের পরিবেশনায় ৪২টি জেলায় এই উৎসব পরিচালনা করবে।যা (২ নভেম্বর) থেকে শুরু হয়েছে শেষ হবে ২০ নভেম্বর।

Author

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker