সারাদেশইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

শীতে খেজুরের রস ও মিঠাই

কথিত আছে ‘খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে, সেই রসে দিয়ে জ্বাল মন ভরে সুবাসে’। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধু বৃক্ষ এই খেজুর গাছ। দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরগাছ।

রস সংগ্রহেও নেই তেমন ব্যস্ততা। কাকডাকা ভোরে খেজুরের রস, মন মাতানো ঘ্রাণ বিরল। শীতের সকালে খেজুর রস, মিষ্টি রোদ, কৃষক কৃষাণির হাসি দারুণ প্রাণশক্তি।

ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকেই তৈরি হতো চিনি। এ চিনি ‘ব্রাউন সুগার’ নামে পরিচিত ছিল। আগে সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনত শীতকালের জন্য। কারণ শীত এলেই খেজুরের রস ও খেজুরের মিঠা গন্ধে গ্রামীণ জনপদ মৌ মৌ করত। এই গাছ গুলো কাটে যারা তাদেরকে ‘গাছি’ বলা হয়।

শীত এলেই গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ত খেজুর গাছ রসের উপযোগী করতে পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত হতে। এতে গাছিরা এই সময় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতো। শীতে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ কাটেন গাছিরা। খেজুরগাছ থেকে রস বের করার উপযোগী করে কাটা শুরু হয় হেমন্তের প্রথমেই।

তারা বিভিন্ন উপকরণ সমন্বয়ে পরিচ্ছন্নভাবে গাছ কাটার জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন দা, দড়ি, এক টুকরো চামড়া বা পুরোনো বস্তা আবার দা রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি থলি বা ঝাঁপি। সে ঝাঁপি গাছিরা রশি দিয়ে খুব যত্নে দা রেখে এ গাছ থেকে সে গাছে উঠা, নামা করে সুবিধা পায়।

আবার কোমরে বেশ কিছু চামড়া বা বস্তা বেঁধে নেয় যেন গাছে উঠা নামায় কোন প্রকার সমস্যা না। গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার সময় কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়।

এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিঁট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিঁট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়।

প্রথম গাছ কাটার পর দ্বিতীয়বার চাঁছ দিয়ে সেখানে বসানো হয় কঞ্চির বিশেষভাবে তৈরি নলি। তার পাশে বাঁশের তৈরি ছোট শলাকা পোঁতা হয় ভাঁড় (কলস) টাঙানোর জন্য। চোখ বেয়ে নলি দিয়ে রস পড়ে ভাড়ে।

খেজুরগাছ কাটা ও তা থেকে রস বের করার মধ্যেও কিছু কৌশল আছে। যে কেউ ভাল করে গাছ কাটতে কিংবা রস বের করতে পারেন না। কখন, কীভাবে, কোন খানে কেমন করে পোঁচ দিতে হবে এবং যার ফলে গাছ মারা যাবে না, অথচ বেশি রস পাওয়া যাবে তা একজন দক্ষ গাছি ই ভালো জানেন। একবার গাছ কাটার পর ২-৩ দিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়।

গাঁও-গেরামের অভাবের সংসারও রস, গুড়, পিঠা-পায়েসের মৌ মৌ গন্ধে ভরে যায়। নদীর পাটা শেওলা ব্যবহার করে তৈরি করা হতো হাজার হাজার মণ চিনি। যা রপ্তানি করা হতো ইউরোপের দেশে। সে সময় গাছিদের কদর ছিল দারুণ। খেজুরগাছ কাটা মৌসুমে খেজুর বাগানেই বাঁধা হতো ছোট কুঁড়েঘর।

সেখানেই চলত গাছিদের খাওয়া-দাওয়া, রাত্রিযাপন। খেজুরগাছ কাটা শুরু হতো দুপুরের পর থেকেই। ভোর থেকে রসের ভাঁড় নামিয়ে তা বাইন বা চুলায় চড়িয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হতো। ৫ মাস গাছিরা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটাতেন।

দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ। রস সংগ্রহেও নেই তেমন ব্যস্ততা। শীতের শুরুতে হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করতে দেখা যায় গাছিদের।

যদিও এক সময় গ্রামীণ জনপদের ঘরে ঘরে এই রস দিয়ে তৈরি হতো নানা ধরনের পিঠা ও পায়েস। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলের এসব সুস্বাদু খাবারের তালিকা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর রস দিয়ে তৈরি খাবার। খেজুর গাছের সুমিষ্ট রসের মৌ-মৌ ঘ্রাণে ভরে উঠতো গ্রামাঞ্চল। গভীর রাতে হাড়ি থেকে রস চুরি করে খাওয়া অনেকের শৈশবের স্মৃতি আজও অম্লান হয়ে আছে।

গ্রামীণ মেঠো পথ, খেজুর গাছের সারি, গাছে রসের হাড়ি আর এখনকার দিনে তেমন একটা চোখে পড়ে না। দেখা মিলে না পাখি আর কীটপতঙ্গের গাছে গাছে রস খাওয়ার দৃশ্য।

কিন্তু বর্তমানে পর্যাপ্ত খেজুরের গাছ না থাকায় গাছিরাও তাদের এই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। তবে খেজুরের কাঁচারস সংগ্রহ, বিক্রয় ও বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাছি ও জনসাধারণকে প্রাণী বাহিত সংক্রামক ব্যাধি নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে জানানো জরুরি। তবে খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় খেতে কোনো বাধা নেই।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker