জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের বেপারী পাড়া গ্রামের ইলেকট্রিক মিস্ত্রি পঞ্চম শ্রেণি পাস রাজু আহম্মেদ এমন একটি ফ্যান তৈরি করেছেন, যা জীবন বাঁচাতে পারে প্রখর রোদে মাঠে কাজ করা কৃষকদের।
তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বৈদ্যুতিক পাখা ঠিক করা এবং কয়েল বাঁধানোর কাজ করে আসলেও কৃষিযন্ত্র নিয়ে কাজ করা তার নেশা। রাজুর তৈরি ফ্যানে বাতাসের পাশাপাশি ছায়াও পাওয়া যায় প্রখর রোদ থেকে।
সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সূর্যের আলোর শক্তিতে চলে বিধায় ফ্যানের নাম দিয়েছে ‘সোলার ফ্যান’।
মাত্র আড়াই কেজি ওজনের সোলার ফ্যানটি কাঁধে লাগিয়ে কৃষকরা মাঠজুড়ে কাজ করতে পারেন।
শুধু কৃষকরা নয় রোদ বৃষ্টিতে কাজ করা শ্রমিকরাও এর সুফল ভোগ করতে পারেন। যেমন – ট্রাফিক পুলিশ, রিক্সা চালক, মাঠে কাজ করা বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক।
রাজু জানান,
আমি একদিন একটা ক্ষেতের সাইডে বসে ছিলাম। দেখলাম, প্রচন্ড রোদের জন্যে এক কৃষক হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলো। পরে সবাই ধরাধরি করে মাথায় পানি দেওয়ার পর ওই বেটা আস্তে আস্তে সুস্হ্য হলো। এ ঘটনার পর থেকেই আমি চিন্তা করতে লাগলাম কৃষকদের জন্যে কী করা যায়। প্রায় ৯ মাস গবেষণা করে কৃষকের ছায়া আর বাতাসের জন্য তৈরী করলাম এই সোলার ফ্যান।
তিনি আরো বলেন, কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষণা করেই আমার দিন যাচ্ছ। আমি যা রোজগার করি তার অর্ধেক সংসারে দেই আর অর্ধেক গবেষণার জন্যে যন্ত্রপাতি কিনি।
আমি প্রথমে ২০১১ সালে আম পাড়ার ডিজিটাল একটা যন্ত্র বানাই।
এরপরে ২০১৬ সালে ঘাস কাটা, মাটির ঢেলা পরিষ্কার করা, ক্ষেত নিড়ানো, হাল দেয়া, মই দেয়া, ভুট্টার বীজ বপন করা যায় এমন বেশ কিছু মেশিন তৈরী করে ছিলাম।
২০১৭ সালে মোবাইল দিয়ে পাখি তাড়ানোর একটা মেশিন তৈরী করি। সরকারি লোকেরা এটার নাম দিছিলো ডিজিটাল কাকতাড়ুয়া। ওই যন্ত্রগুলো এখন আর আমার কাছে নেই। বিভিন্ন সময় সরকারি লোক এসে নিয়ে গেছে, কিন্তু পরে আর তেমন সাড়া পাইনি।
এসব কারণে ২০১৭ সালে রাজু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং অনেকটা অভাবগ্রস্তও হয়ে পড়েন। এরপর টানা তিন বছর এ ধরনের কাজ থেকে দূরে ছিলেন।
এরপরই ক্ষেতের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়া কৃষকের কথা মনে করেই রাজু সোলার ফ্যানটি তৈরি করেন।
যন্ত্রটি তৈরি করতে রাজু ২০ ওয়াটের একটি সোলার প্যানেল, ১২ ভোল্টের ডিসি দুটি ছোট ফ্যান, দুটি সুইচ, একটি বেল্ট ও বডি মেকানিক্যাল ব্যবহার করেছেন।
রাজু আরো বলেন, এই ফ্যান তৈরি করতে আমার অনেক খরচ হয়েছে।ব্যাটারি দিলে অনেক ওজন হয়, আর কারেন্টের বানাইলে কৃষকের খরচ বেশি হবে। তাই সোলার ফ্যান বানাইছি। প্রথমে দুইটা ফ্যানের ওজন বেশি হওয়ায় বাদ দিয়ে দিছি। পরে এখন এটা বানাইছি। এটার ওজন আড়াই কেজি। এটা তৈরি করতে আমার চৌদ্দ’শ টাকা খরচ হয়েছে।
সোলার ফ্যান নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যদি সরকারি সহায়তা পাই, তাহলে এই ফ্যানটি চারভাবে তৈরি করে বাজারে ছাড়বো। যদি ভালোভাবে বানাতে পারি তাহলে কৃষকরা ৩০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকার মধ্যে এই ফ্যান কিনতে পারবে। এর ফলে কৃষকরা অনেক উপকৃত হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে রাজু বলেন, আমি একটা ইঞ্জিন বানিয়েছি। যেটা কোন প্রকার জ্বালানি ছাড়াই শুধুমাত্র বাতাস দিয়ে চলবে। এর কাজ ৯০ শতাংশ শেষ করেছি। কিছু কাজ বাকি আছে। এর জন্যে অনেক টাকার প্রয়োজন, তাই সরকারি সহায়তার খুব প্রয়োজন।
শরিফপুর ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, রাজু যে ফ্যান বানিয়েছে,তা আমারসহ সব কৃষকেরই দরকার। কিন্তু আর্থিক সংকট থাকায় রাজু চাহিদা থাকলেও ফ্যান সাপ্লাই দিতে পারতেছে না।
শরিফপুর ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আলম বলেন,স্থানীয় জন প্রতিনিধি হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমার পরিষদের পক্ষ থেকে রাজুকে যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার করবো। এতে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
জামালপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ মঞ্জুরুল কাদির বলেন, রাজু উদ্ভাবন পাগল একজন মানুষ। সে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে খুবই ভালোবাসে। তবে সে অত্যন্ত গরিব বলে এই যন্ত্রটি উন্নত করতে পারছে না। কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে তারা জয়দেবপুরে কৃষি প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। রাজুকে প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহযোগিতা করা যায় কি না সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।