বাণিজ্য

ইইউ এবং দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রি ট্রেড ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের কারণ হবে

বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বিশেষ করে ইউরোপে রপ্তানিকারকরা এক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন ইউরোপের একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কারণে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) দক্ষিণ আমেরিকার চারটি বৃহৎ দে — ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ের সঙ্গে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো এই চুক্তি গ্রহণ করে আইনগত সম্মতি দিলেই চুক্তিটি দাপ্তরিকভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। সেটি হলে এই চুক্তি হবে সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি।চুক্তির শর্তে কী আছে এবং মুক্ত বাণিজ্য বা ফ্রি ট্রেডের অধীনে কী কী অন্তর্ভুক্ত আছে তা এখনো সেভাবে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়নি।

তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এমন সময় সম্পাদিত হয়েছে, যখন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনান্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই ট্রাম্প তার বাণিজ্যিক অস্ত্র, উচ্চ হারের ট্যারিফ, প্রয়োগ করার হুমকি দিয়েছেন সেইসব দেশের বিরুদ্ধে, যেখান থেকে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করা হবে। যদিও ট্রাম্প মূলত চীনকে টার্গেট করেই উচ্চ হারের ট্যারিফ ধার্য করতে চেয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে তার এই ট্যারিফ অস্ত্র সব দেশের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

এমনকি আমেরিকার মিত্র দেশ কানাডা ও ইউরোপও ট্রাম্পের এই উচ্চ হারের ট্যারিফ আরোপের লক্ষ্যে পরিণত হবে।
ইইউ এবং দক্ষিণ আমেরিকার বৃহৎ চারটি দেশের সঙ্গে যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা এখনো কার্যকর হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ এই চুক্তি গ্রহণ করে স্বীকৃতি (রেটিফাই) দিলেই চুক্তিটি কার্যকর হবে। এটি মূলত একটি আনুষ্ঠানিকতা এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এরই মধ্যে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতিবিদ, থিংকট্যাংক ও নীতিনির্ধারকরা এই বাণিজ্য চুক্তিকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। আন্তর্জাতিক একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে এই চুক্তিটি উভয় পক্ষের জন্য উইন-উইন বাণিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টি করবে।

তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য চুক্তির ফলে উভয় অঞ্চলের ভোক্তা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি সমভাবে লাভবান হবে।

যেমন—ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের কৃষক সম্প্রদায় এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। তাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই চুক্তি কার্যকর হলে ইউরোপ ব্রাজিলের কৃষিপণ্যের উন্মুক্ত বাজারে পরিণত হবে। ফলে এসব দেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভিজ্ঞদের মতে, এই বিরোধিতা টিকবে না। কারণ তাদের বিরোধিতা মূলত কৃষিপণ্য নিয়ে, অথচ এই কৃষিপণ্য, যেমন—সয়াবিন, ওয়েল সিড, কফি, পাল্প উড প্রভৃতি আইটেম ব্রাজিল থেকে নিয়মিত ইউরোপে রপ্তানি হয়ে আসছে।

আরো একটি উদ্বেগের বিষয় আছে, তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে যেতে পারে, যা তারা উচ্চ সুদের হার প্রয়োগ করে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। এ ব্যাপারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়াইন লেগারডে সম্প্রতি ফিন্যানশিয়াল টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইউরোপের দেশগুলো যদি ট্রাম্পের উচ্চ হারে ট্যারিফ আরোপের সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে বিশ্বব্যাপী পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে, যা মূল্যস্ফীতি মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।

অর্থনৈতিক ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প যে তার পূর্বঘোষিত উচ্চ হারের ট্যারিফ আরোপের পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা একতরফা উচ্চ হারে ট্যারিফ আরোপ করবে আর অন্যরা চুপচাপ মেনে নেবে, সেই অবস্থাও নেই। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকার ব্যাবসায়িক পক্ষ, বিশেষ করে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, যেমন—জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং চীন যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ফলে আগামী কয়েক বছর যখন ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকবেন, তখন বিশ্ববাণিজ্যে ট্যারিফযুদ্ধ অনিবার্য। এই ট্যারিফযুদ্ধের পরিণতিই বা কী হবে এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশী দেশ (ট্রেডিং কাউন্টারপার্ট) কিভাবে এটি মোকাবেলা করবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। এখন পর্যন্ত যেভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তাতে একাধিক বিষয় উঠে এসেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনে বা পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা, ২. আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, ৩. আঞ্চলিক বিনিয়োগের মাত্রা ও ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন এবং ৪. পণ্য উৎপাদনের স্থান পরিবর্তন।

এসব সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখে অনেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। চীন থেকে অনেক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য উৎপাদন কেন্দ্র বা প্রডাকশন ফ্যাক্টরি অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা যে ধরনের উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন, তাতে তাদের পক্ষে এই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।

এই ধরনের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা ও মানসিক শক্তি থাকতে হবে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সেটি আপাতত আছে বলে হয় না। সম্প্রতি কালের কণ্ঠ ও ডেইলি সান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি খুব ভালোভাবেই উঠে এসেছে।

যা হোক, ট্রাম্পের আলোচিত-সমালোচিত ট্যারিফযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবেই যে ইইউ দক্ষিণ আমেরিকার বৃহৎ চারটি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপের এই বাণিজ্য চুক্তির প্রভাব বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ওপর কতটা পড়তে পারে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। কেননা চুক্তির বিস্তারিত শর্ত এবং কোন ধরনের পণ্যসামগ্রী এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসবে, তার ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব কেমন হবে।

তবে ট্রাম্পের ঘোষিত ট্যারিফযুদ্ধের মূল লক্ষ্য চীন; এবং এ কারণে চীন থেকে এরই মধ্যে উৎপাদনকেন্দ্র অন্য অঞ্চলে সরতে শুরু করেছে। ফলে এসব সাপ্লাই সোর্স এশিয়া থেকে একেবারে দক্ষিণ আমেরিকায় স্থানান্তরিত হতে পারে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কারণে ট্যারিফ ও ট্যারিফ-বহির্ভূত বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর হবে এবং অনেক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেসব দেশে ফ্যাক্টরি স্থাপন করে খুব সহজেই ইউরোপে রপ্তানি করতে পারবে।

এর পাশাপাশি উত্তর আমেরিকা, তথা আমেরিকা-কানাডার বাজার স্বল্প দূরত্বের কারণে অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে থাকবে। তেমনটা হলে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাই বেশি; বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। কেননা ইউরোপ আমাদের দেশের একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি বাজার।

ইউরোপের এই বাণিজ্য চুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানোর উপায় কী হতে পারে। কাজটা আপাতদৃষ্টিতে কঠিন হলেও একেবারে যে অসম্ভব তেমন নয়। কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এবং ব্যবসায়ীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে সরকারকে। এখন ব্যবসায়ীরা যে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছেন, সেখান থেকে তাদের বের করে এনে একটি টেকসই আস্থার জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই ধরনের ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে ব্যবসা অব্যাহত রাখতে হলে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে।

ভবিষ্যতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার নিশ্চয়তা না থাকলে ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। তাই দেশের বর্তমান সরকার, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তাদের উচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে এই মর্মে নিশ্চয়তা দেওয়া যে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, ব্যবসায়ীরা সব কিছুর বাইরে থাকবেন এবং তাদের ব্যবসা পরিচালনায় কোনো রকম সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না।

এটি শুধু মুখে বললে হবে না, কার্যক্ষেত্রে দেখাতে হবে এবং সেই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একবার ব্যবসা অন্যত্র চলে গেলে খুব সহজে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

সরকার ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পাওয়ার পর ব্যবসায়ীদেরও একটু নড়েচড়ে বসতে হবে এবং তৎপর হতে হবে। ইউরোপের ফ্রি ট্রেড চুক্তির প্রভাব যাতে না পড়ে সে জন্য ব্যবসায়ীদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, এই চুক্তিটির দিকে বিশেষ নজর রাখা এবং কী ধরনের পণ্য এই চুক্তির আওতায় আসবে সেটি ভালো করে জানা।

দ্বিতীয়ত, যেসব ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী এই চুক্তিভুক্ত দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে বা স্থানান্তর করবে, তাদের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ করে সেইসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বা মাধ্যমে রপ্তানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, ইউরোপের ব্যাবসায়িক অংশীদার বা পার্টনার, বিশেষ করে সেখানকার আমদানিকারকদের সঙ্গে আগে থেকে আলোচনা করে দক্ষিণ আমেরিকার চুক্তিবদ্ধ দেশের চেয়েও সাশ্রয়ী মূল্যে এবং স্বল্প সময়ে পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের ধরে রাখা।

এ রকম আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, যা উল্লেখ করতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে নেই।

Author

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker